শ্রী চৈতন্য প্রভুর আবির্ভাবের কারণ

শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভূর আবির্ভাব সম্পর্কে ভবিষ্যৎবানী দিয়ে ভাগবতে বলা হযেছে-
কৃষ্ণ বর্ণের ত্বিষাকৃষ্ণের সঙ্গো পাঙ্গাস্ত্র পার্ষদম
যঙ্গেঃ সংকীর্তন প্রয়ৈযন্তি হি সুমেধস॥
অর্থাৎÑ“কলি যুগের যেসব বুদ্ধিমান মানুষেরা ভগবৎ আরাধনার উদ্দেশ্যে সংকীর্তন যজ্ঞানুষ্ঠান করবেন। তারা অবিরাম শ্রীকৃষ্ণের নাম গানের মাধ্যমে ভগবৎ অবতারের আরাধনা করেন। যদি তার দেহ কৃষ্ণবর্ণ হয়; তা হলেও তিনি সয়ং শ্রীকৃষ্ণ। তার সঙ্গে অস্ত্র ও পার্ষদরুপে থাকবেন তার অন্তরঙ্গ সঙ্গীরা এবং সহযোগীবৃন্দ”।
শ্রীমদ্ভাগবতের এই ভবিষ্যতবানী সফল করে গৌড়দেশের পূর্বদিগন্তে উদিত সূর্যের ন্যায়; রক্তিম প্রভায় জগতের অন্ধকার নাশ করে আবির্ভূত হলেন কলিযুগ পাবনাবতারী শ্রী শচীনন্দন গৌরহরি। অরুন উদয়ে যেমন অন্ধকার নাশ হয়। গৌর আগমনে ও জাতের অন্ধকার নাশ হয়েছিল।
 রাধা ও কৃষ্ণ স্বরুপত এক। নিত্য বৃন্দাবনে নীলারস আস্বাদনের জন্য পৃথক দুই চিন্ময় দেহ ধারন করেছিলেন। সেই দুই চিন্ময় দেহ পুনরায় একত্রে যুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নামে প্রকট হওয়ার বাসনা করলেন। শ্রীমতি রাধারানীর ভাব ও কান্তিযুক্ত হয়ে শচী গর্ভসিদ্ধ থেকে গৌড়চন্দ্র উদিত হলেন। শ্রীকৃষ্ণ বৃন্ধাবনে ব্রজগৌপিদের নিয়ে যে মধুর লীলারস আস্বাদন করেছিলেন। গৌরচন্দ্রের চন্দ্রিকাপাতে রাধা কৃষ্ণ লীলা জগৎ জনের কাছে প্রকাশিত হল। জগৎবাসীরা জানল রাধার প্রেম কি? রাধাকৃষ্ণ লীলার মর্মার্থ কী? তাই মৌলভীবাজার রতন বাসুঘোষ কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে-
যদি গৌর না হইত, তবে কি হইত,
কেমনে ধরিতাম দে।
রাধার মহিমা
প্রেম রস সীমা
জগতে জানাত কে?

সেই রাধা কৃষ্ণ মিলিত তনু গৌরাঙ্গ গোসাই; মহাবিষ্ণুর অবতার অদ্বৈত আচার্যের হুঙ্কারে গোলক থেকে আবির্ভূত হলেন ব্রহ্মা আদির দুর্লভ নামে প্রেমে নিজে নেচে জগতকে নাচায়ে, নিজে কেঁদে জগতকে কাঁদায়ে, নাম প্রেম অকাতরে বিলিয়ে সংকীর্তন রুপ যুগ ধর্মের প্রবর্তন করতে। এসব গৌর হরির অবতরনের গৌরকরন। রাধার বরন শ্যামের গড়ন নিয়ে গৌর হরির আবির্ভাবের মুখ্য কারন হল গৌপী প্রেমের ঋনশোধ করার মাধ্যমে ব্রজলীলার তিনটি অপূর্ণ সাধপুরন। গৌরহরি যিনি মদনমোহন, শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তিনি এতই ঐশ্বর্যশালী যে সমগ্র জগৎ উনার মোহনীয় মদনবানে জর্জরিত। কিন্তু মদনমোহন রাধারানীর মোহনীয় আকর্ষনে জর্জরিত। তাই পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ ভাবছেন রাধার প্রেমে কি এমন শক্তি যে কারণে আমি রাধার কাছে বশ। সে সম্পর্কে বর্ণনা করে শ্রীল স্বরুপ দামোদর গোস্বামী স্বীয় করচায় লিখেছেনÑ
শ্রীরাধায়া প্রনয়মহীমা কী ছলো বানয়ৈবা
স্বাদ্যো ঘেনাদ্ভুত মধুরিমা কীদৃলো বা মদীয়া;
মৌখ্যঞ্চাস্য মদনুভবত: ক’ছশং বেতি লোভা
ওদ্ভাবাত্য: সমজনি শচীগর্ভ সিন্ধৌ হরীনু।

অর্থাৎÑশ্রীরাধার প্রেমের মহীমা কিরবাম ঐ প্রেমের দ্বারা শ্রীরাধা আমার যে অদ্ভুত মাধূর্য আস্বাদন করেন। সেই মাধুর্যই বাকি রকম এবং এবং আমার মাধুর্য আস্বাদন করে শ্রীরাধা যে সুখ অনুভব করেন, সেই সুখই বাকি রকম এই সমস্থ বিষয়ে লোভ জন্মাবার ফলে শ্রীরাধার ভাবযুক্ত হয়ে শ্রীকৃষ্ণ রৃপ চন্দ্র শচীগর্ভসিন্ধুতে আবির্ভূত হয়েছেন। সেই একই বিষয়টি ল করে চৈ: চ: আ:৪র্থ পরিচ্ছেদে শ্রীকৃষ্ণ উক্তিÑ
আমা হৈতে রাধা পায় সে জাতীয় সুখ
তাহা আস্বাদিতে আমি সদাই উন্মুখ।

নানা যতœ করি আমি নারী আস্বাদিতে। যে সুখ মাধুর্য্য ঘ্রানে লোভ বাড়ে চিত্তে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সেই একই লোভ তিনি সেই মাধুর্য্যরস কবে আস্বাদন করবেন। তাই কলি যুগে নদীয়াতে অবতীর্ন হলেন গৌরহরি। গৌরহরির অবতরনের আরও কারণ উল্লেখ করে চৈ: চ: আ:-৪র্থ পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে-
রস আস্বদিতে আমি কৈল অবতার। প্রেমরস আস্বাদিল বিবিধ প্রকার।
রাগমার্গে ভক্তভক্তি করে সে প্রকারে। তা সেখাইল লীলা আচরন দ্বারে।

তাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহা প্রভূ কলিতে প্রকট হয়ে সেই রস আস্বাদন করলেন এবং নিজে আচরন করে জীবকে রাগানুরাগ ভক্তি শিা দিলেন। ব্রজলীলায় সেই রাগানুরাগ ভক্তি নিত্য উৎকর্ষতা লাভ করছে এবং এই ব্রজলীলা গোলক ধামে নিত্য বিরাজিত। সেই ব্রজলীলা শ্রীকৃষ্ণ দ্বাপরের শেষে নকালের জন্য ভারবর্ষের বৃন্দাবন নামক স্থানে প্রকাশ করেছিলেন। সে লীলা হচ্ছে ভগবানের সাথে উনার মাতাপিতা, কান্তা, সখা, দাসদের লীলা। সে লীলা প্রেমপ্রীতি, স্নেহ, ভালবাসার লীলা। ভগবানকে জগন্নাথ, জগদীশ না ভেবে নিজের প্রিয়জন মনে করে সে ভালবাসা সেই তাই ব্রজলীলা। শ্রীকৃষ্ণ আমার পুত্র, আমার বন্ধু চড়েছেণ, মা যশোদা শুদ্ধ বাৎসল্যে তাকে শাসন ও লালন পালন করেছেন, মতি রাধা ঠাকুরানী মান ভরে তাকে তিরষ্কার করেছেন। এইসব মিলিয়েই ব্রজলীলা। শ্রীকৃষ্ণ এই ব্রজলীলার রাগ ও অনুরাগময় ভক্তির অভিপ্রায় ব্যাক্ত করেছেন এভাবে মাতা মোরে পুত্র ভাবে করেন বন্ধন। অতিহীনজ্ঞানে করেন লালন পালন। সখাশুদ্ধ জ্ঞানে করে স্কন্ধে আরোহন। তুমি কোন বড় লেখক তুমি আমি সম। প্রিয়া যদি মান করি, করয়ে ভৎসন। বেদস্তুতি হৈতে হরে মোর মন। চৈ:চ:আ:৪/২৪-২৬
এই মাধুয্য মন্ডিত ব্রজলীলার প্রেম ভক্তিই হচ্ছে রাগানুগা ভক্তি। প্রভু নকাল ধরাধামে লীলা শেষ করে চিৎজগতের সর্বোচ্চ ধাম গোলক বৃন্দাবনে গিয়ে ভাবছেনÑ
চিরকাল নাহি করি প্রেমভক্তি দান।
ভক্তিবিনা জগতের নাহি অবস্থান।
সকল জগতে মোরে করে বিধি ভক্তি। বিধি ভক্তে ব্রজভাব পাইতে নাই শক্তি। চৈ:চ:আ:৩/
আমি যে ব্রজলীলার মাধূর্য্য আস্বাদন করলাম ও করছি তাতো পাপ হতে অধম জীব লাভ করতে পারল না, কারণ তাদের আমি প্রেমভক্তি শিা দেইনি। শাস্ত্রে বিধি নিষেধ মেনে আচার নিষ্টার ভিতর দিয়ে জীব যে আমার ভক্তি করে তাতে বৈকুন্ট লাভ করে সত্য কিন্তু ব্রজের এই পরম উৎকর্ষময় প্রেমলাভ করতে পারে না। তার আমার ভজনা করে আমাকে ঈশ্বর মনিব ভেবে; এই ভাবে বিধি মেনে ব্রজলীলার প্রেমলাভ হয় না। ব্রজপ্রেমলাভ করতে হলে চাই রাধিকা তথা ব্রজগোপীর ভাবে প্রেমে প্রেমাবিষ্ট হওয়া, শ্রীদাম সখার মত ভাব নিয়ে প্রীতি ও ভালবাসার সম্পর্ক সৃষ্টি করা। নন্দ যশোদা দেবকী বসুদেবের মত বাৎসল্যে ভোরে আগলে রাখার মতা। আর এটাই রাগানুরাগ ভক্তি। এই পরম উজ্জল প্রেমভক্তি সমগ্র জগতে বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে পাপপঙ্কিল কাল হত জীবকে উদ্ধারের সংকল্প নিয়ে গোলকপতি এলেন ভূলোকে। তাই শ্রীরুপ গোস্বামী বিদগ্ধ মাধবে(১/২) বলেছেনÑ
অনর্পিতচরীর চিরাৎ করুনাবতীর্নঃকলৌ
সমর্পায়তুমুন্ন তো জ্বলরায়ং স্বভক্তি শ্রিয়ম।

{অর্থাৎ-যা ছিল চির অনর্পিত-অর্থাৎ কোন কালে যা কাউকে দান করা হয়নি। সেই উজ্জল মধুররসে রসাল নিজস্ব প্রেম সম্পদ বিলিয়ে দেবার জন্য করুনা বশতঃই তিনি কলিযুগে অবতীর্ণ হয়েছেন।}
চির অনর্পিত এই প্রেম ভক্তি রাগানুরাগ ভক্তি স্বর্গের মন্দা কিনীর ধারার মতন ভগবান গৌরহরি কলিহত জীবকে দান করে জীবের উপর বিশেষ কৃপা করি বর্ষন করেছেন। নিজে আচরন করে জগতকে আচরন করার নির্দেশ দিয়েছেন। জগৎ স্বামী সেই দুর্লভ প্রেমভক্তি লাভ করে ব্রজবাসী হউন, দিব্য প্রেম আস্বাদন করুন, গৌরচরনে প্রনত হয়ে সুখী হউন। জয়গৌর।
শ্রীল রূপ সনাতন গোস্বামীর সংপ্তি জীবন চরিত্র থেকে শ্রী গোবিন্দ দেবের প্রকট (সংকলিত)

0 comments:

Post a Comment