প্রেমভক্তি ও নাম সংকীর্তন - শ্রীগোপেশ চন্দ্র সূত্রধর
শ্রীমদ্ভগবদগীতার দ্বাদশ অধ্যায়ের নাম হলো ‘ভক্তিযোগ’। অব্যক্ত ব্রহ্মকে কর্মের দ্বারা, বা চিন্তার দ্বারা লাভ করা যায়। অর্থাৎÑ কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ দ্বারা ভগবানকে লাভ করা যায় বটে, কিন্তু কর্মযোগ ও জ্ঞানযোগ বড়ই কঠিন। ইহারা ভক্তিযোগের মতো এত সহজ নয়। তাই ভগবান বলছেন যে, তাঁকে পাওয়ার জন্য সহজ পথ হচ্ছেÑ ভক্তির পথ।
        মানুষের মন বড়ই চঞ্চল। এই চঞ্চল মনকে বশে আনা বড়ই দূরহ ব্যাপার। সংসারের বিষয়-বাসনা সব সময় ভগবানকে বিমুখ করে রাখে। জগতের এই বিষয়-বাসনাকে ত্যাগ করাও বড় কঠিন কাজ। এই বিষয়-বাসনাকে ত্যাগ করতে না পারলে মন ভগবানে স্থিরতা লাভ করে না।  ভক্তির দ্বারা এই চঞ্চল মনকে বিষয় হতে দূরে রেখে ভগবানের পাদপদ্মে সমর্পণ করতে হয়।  তাই এই চঞ্চল মনকে স্থির করতে হলে নিত্যদিন সদ্গ্রন্থপাঠ, ভক্তিসহকারে নিত্যদিন ভগবানের সেবা, স্মরণ, মনন ও কীর্তন করতে হয়। এই ভক্তির দ্বারাই মনকে সহজে ভগবানের  শ্রীপাদপদ্মে নিবিষ্ট করা যায়।


       ভক্তির কথাটা বললেই ভক্তের কথাটি চলে আসে। ভক্ত কে? যার মন সর্বদা ঈশ্বরে নিমগ্ন থাকে তাকেই ‘ভক্ত’ বলে। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেনÑ “ভক্তিই সার; ঈশ্বর তো সর্বভূতে আছেন; তবে ভক্ত কাকে বলি? যার মন সর্বদা ঈশ্বরে আছে। আর অহংকার অভিমান থাকলে হয় না। ‘আমি’ রূপ ঢিপিতে ঈশ্বরের কৃপারূপ জল জমে না, গড়িয়ে যায়। আমি যন্ত্র।” (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতÑ৫/২/১)
         তাহলে ভক্তি কাকে বলে? সাধারণত ভক্তি বলতে ঈশ্বরের প্রতি একান্ত অনুরাগকে-ই ‘ভক্তি’ বলে। যাগ,যজ্ঞ, ধ্যান ইত্যাদিতে যদি হৃদয়ের পরশ না লাগে তবে চিত্ত শুদ্ধ হয় না। তাই ভগবানের প্রতি হৃদয়ের পরশকেই ভক্তি বলা হয়। ঈশ্বরে পরম প্রেম-ই হলোÑ‘ভক্তি’। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়Ñ আত্ম-স্বরূপের অনুসন্ধানের ব্যাকুলতাই হলোÑ ‘ভক্তি’।
বিবেকচুড়ামণিতে বলা হয়েছেÑ
                                           “মোকারণসামগ্র্যাং ভক্তিরেব গরীয়সী।
                                            স্ব স্বরূপানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যভিধীয়তে।”
                                           স্বাত্মত্ত্বানুসন্ধানং ভক্তিরিত্যপরে জগুঃ ॥ (বিবেকচূড়ামণিÑ৩১)
অর্থাৎÑ মোকের সাধনসমূহের মধ্যে ভক্তিই শ্রেষ্ঠ। নিজের স্বরূপ চিন্তনকে ভক্তি নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। কেহ কেহ বলেন, আত্মার ও পরমাত্মার তত্ত্ববিচারের নামই হলোÑ ‘ভক্তি’। এক কথায় নিজের স্বরূপকে জানার যে অপার সাধনা তাকেই ‘ভক্তি’ বলে।
         ভক্তি শব্দটি ভজ্ ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হচ্ছেÑ‘ভজনা’। ভজনা কাকে করবো? এখানে ভগবানকে ভজনা করার ভাবটিই অন্তুর্রনিহিত হয়ে আছে। ভক্তি তত্ত্ব সমস্পর্কে ‘বোধসার’ গ্রন্থে উলেখ করা হয়েছেÑ
যয়াত্র রক্তো জীবোহয়ং দধাতি ব্রহ্মরূপতাম্।
সাধিতা সনকাদ্যৈঃ সা ভক্তিরিত্যাধীয়তে ॥(বোধসারÑ৩২/৩)
অর্থাৎÑ শুদ্ধ আত্মায় প্রেমাসক্তি জন্মালে জীব ব্রহ্মরূপতা লাভ করে। সনকাদি ঋষিরা যে প্রেমাসক্তি লাভ করেছিলেন তা-ই হলোÑ ‘ভক্তি’। আচার্য শঙ্করও বলেছেনÑ“মোলাভের জন্য যত প্রকার সাধনা আছে তার মধ্যে ভক্তিই শ্রেষ্ঠ।” আর শ্রীমদ্ভাগবত বলেছেনÑ         
“যদৃচ্ছয়া মৎকথাদৌ জাতশ্রদ্ধস্তু যঃ পুমান্।
ন নির্বিণেœা নাতিসক্তো ভক্তিযোগো ’স্য সিদ্ধিদঃ ॥” (শ্রীমদ্ভাগবতÑ১১/২০/৮)
অর্থাৎÑআমার বা আত্মার কথা শ্রবণ করার ফলে যাঁর অন্তরে শ্রদ্ধার উৎপত্তি হয়েছে, কিন্তু সংসারের প্রতি তাঁর বৈরাগ্য আসে নাই, আবার সংসারের প্রতি তাঁর মোহ বা আসক্তিও আছে এমনও বলা যায় না, তাঁদের পে ভক্তিযোগই ভালো। এই পথেই তাঁর পে সিদ্ধিলাভ করা সম্ভব। আর শ্রীমৎ মধুসূদন সরস্বতী বলেছেনÑ“ভগবানের মহিমা শ্রবণ করে চিত্ত যখন প্রশান্তিতে দ্রবীভূত হয় তখন পরমাত্মার প্রতি চিত্তের যে এক নিরন্তর প্রবাহের প্রকাশ ঘটে তা-ই হলোÑ ‘ভক্তি’।
আমাদের বৈদিক সাহিত্যে ভক্তির কোনো উলেখ পাওয়া যায় না বটে, কিন্তু অনেক উপনিষদেই শ্রদ্ধা কথাটির উলেখ পাওয়া যায়। তবে শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্ এর শেষ মন্ত্রে এই ভক্তি কথাটির উলেখ রয়েছে।
“যস্য দেবে পরা ভক্তির্যথা দেবে তথা গুরৌ।
তস্যৈতে কথিতা হ্যার্থাঃ প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ
প্রকাশন্তে মহাত্মনঃ ॥ (শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ্Ñ৬/২৩)
    অর্থাৎÑ ঈশ্বর এবং গুরুর প্রতি যাঁর অবিচল ভক্তি আছে তিনিই যথার্থ মহাত্মা। এই রূপ অধিকারীর মনেই সত্যের স্বরূপটি প্রকাশিত হয়।  বস্তুত ঈশ্বর, নিজের আত্মা ও গুরুর প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা বা পরাভক্তি থাকতে হবে। আর এই ভক্তিই সাধককে তাঁর চরম ল্েয পৌঁছে দেবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এই ভক্তি পরমাত্মাকে অর্থাৎÑ পরমেশ্বরকে বুঝবার এক মহান সাধন ও এক মহান কর্ম। তাই শ্রীভগবান  গীতায় বলেছেনÑ
“ভক্ত্যা মামাভজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্ ॥” (শ্রীগীতাÑ১৮/৫৫)
    অর্থাৎÑ এই পরাভক্তি দ্বারা তাঁরা আমাকে স্বরূপতঃ জেনে নেন যে, আমি কে? এবং আমার স্বরূপ কী? আমাকে তত্ত্বতঃ  জেনে তাঁরা আমাতে প্রবেশ করেন।
       স্বামীবিবেকানন্দ বলেছেনÑ “অকপটভাবে ঈশ্বর অনুসন্ধানই ‘ভক্তিযোগ’। প্রীতি ইহার আদি, মধ্য ও অন্ত। মুহূর্তস্থায়ী ভগবৎপ্রেমোন্মত্ততা হইতেও শাশ্বাতী মুক্তি আসিয়া থাকে।” আর নারদীয় ভক্তিসূত্রে বলা হয়েছেÑ
“সা ত্বস্মিন্ পরম প্রেমরূপা।” (নারদীয় ভক্তিসূত্রÑ২)
    অর্থাৎÑভগবানের প্রতি অপরিসীম ভালবাসাই হচ্ছেÑ ‘ভক্তি’। ভক্তির স্বরূপ অতি অবর্ণনীয়। ইহাকে কোনো প্রকার ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। তাই দেবর্ষী নারদ ইহাকে অতি সংেেপ বলেছেনÑ “ঈশ্বরের প্রতি পরম প্রেমই হলোÑ ‘ভক্তি’।” এখানে দেখা যাচ্ছে যে, ভক্তির সাথে ‘প্রেম’ বিষয়টি জড়িত রয়েছে। তাহলে ‘প্রেম’ বলতে কী বুঝায়? ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগই হলো ‘প্রেম’। বস্তুত প্রেম আর ভক্তি একই বস্তু।
    ঈশ্বরে অনুরাগই হলোÑ প্রেম বা ভক্তি। এই অনুরাগের কথা বলতে গিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেনÑ “শ্রীমতী (রাধিকা) যখন বললেন, কৃষ্ণময় দেখছি, সখীরা বললে, কৈ আমরা তো তাঁকে দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কি প্রলাপ বোক্চো? শ্রীমতী বললেন, সখি, অনুরাগ অঞ্জন চে মাখো, তাঁকে দেখতে পাবে।
(বিজয়ের প্রতি) তোমাদের ব্রাহ্মসমাজের গানে আছেÑ
“প্রভু বিনে অনুরাগ ক’রে যজ্ঞ যাগ, তোমারে কি যায় জানা!”
   “এই অনুরাগ, এই প্রেম, এই পাকাভক্তি, এই ভালবাসা যদি একবার হয়, তা হ’লে সাকার-নিরাকার সাাৎ হয়।” এই ভালোবাসার নামই হলোÑ ‘প্রেম’। কিন্তু প্রেমভক্তি সকল সময় হতে হবে শুদ্ধ, স্বচ্ছ ও নির্মল। শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছেÑ
“শুদ্ধভক্তি হৈতে হয় প্রেমের উৎপন্ন।
অতএব শুদ্ধভক্তির কহিয়ে লণÑ॥”(মধ্যলীলা-২, ১৯পরিচ্ছেদÑ১৪৭)
অর্থাৎÑ শুদ্ধ ভক্তি বা নির্মল ভক্তি হতেই শুদ্ধ প্রেমের উৎপন্ন হয়। যে প্রেমের মধ্যে কোনো প্রকার আবিলতা বা মলিনতা থাকে না। এই আবিলতাই হলো সংসারের কামনা-বাসনা আর  মোহ। এই প্রেমভক্তির মধ্যে কোনো প্রকারের মোহ  থাকতে পারবে না। এই প্রেম আর ভক্তির কথা বলতে গিয়ে ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথও বলেছেনÑ
“মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া
প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া।”
    প্রেমের মধ্য দিয়েই ভক্তির উদয়, আর এই ভক্তির দ্বারাই জীবের মুক্তি। ভক্তিই মুক্তির সহজ পথ। কিন্তু এই ভক্তি বা প্রেমের মধ্যে কোনো প্রকারের কারণ বা হেতুও থাকতে পারবে না। যে ভক্তির মধ্যে কোনো হেতু থাকে না তাকেই অহৈতুকী ভক্তি বলে। এই অহৈতুকী বা নিস্কামা ভক্তিকেই  প্রকৃত প্রেম বা ভক্তি বলে। এই নিষ্কামা ভক্তিই হলোÑ শুদ্ধ ভক্তি। এই শুদ্ধ প্রেমের কথা বলতে গিয়েই দেবর্ষী নারদ এখানে একটি বিশেষণ ‘পরম’ কথাটি যুক্ত করেছেন। এই ‘পরম’ শব্দটি শুধু পরিমাণগত নয়, ইহা গুণগতও বটে। আমাদের এই পার্থিব জগতের ভালোবাসার মধ্যে স্বার্থের অনেক গন্ধ মিশ্রিত থাকে। নিঃস্বার্থ ভালোবসা কোথাও খোঁজে পাওয়া যায় না। তবে অনেকে বলতে পারেন সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা তো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, নিঃস্বার্থ প্রেম।
 কিন্তু না, এর গভীরে ল্েয করলেও দেখা যাবে যে, এই ভালোবাসার অন্তরালেও একটি স্বার্থের গন্ধ পাওয়া যায়।  সেই স্বার্থটা হলোÑ মা সন্তানকে ভালোবেসে আনন্দ পান, তাই তিনি তার সন্তানকে ভালোবাসেন। যেমন ছোট্ট শিশু সে তার মাকে ভালোবাসে, তখন তার মায়ের কাছে কোনো প্রত্যাশা থাকে না। কিন্তু সে যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে তখন তার মায়ের কাছে কিছু কিছু প্রত্যাশা করতে থাকে। তখন তার ভালোবাসা আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা থাকে না। কিন্তু ভগবানকে ভালোবাসতে হলে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে হবে। ইহাই হলো প্রেম বা ভক্তির চরম শর্ত। এই জন্যই নারদ এই ‘পরম’ বিশেষণটি যুক্ত করেছেন। এই ‘পরম’ বিশেষণটিই ভক্তিকে সাধারণ প্রেম বা ভক্তিকে পৃথক করে তোলেছে। এই ‘পরম’ বিশেষণটির একটি বিশেষ গুণ হচ্ছেÑ শুদ্ধ, স্বচ্ছ ও নির্মল প্রেম বা ভক্তি। যে ভক্তিতে স্বার্থের কোনো গন্ধ থাকে না।
    আমরা ভগবানকে ভক্তি করি বটে, কিন্তু এর অন্তরালে  ভগবানের কাছে আমাদের অনেক চাওয়া ও পাওয়া থেকে যায়। তাই তা শুদ্ধ ও নির্মল ভক্তি হয় না।
শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছেÑ            
“এই শুদ্ধভক্তি ইহা হৈতে প্রেম হয়।
পঞ্চরাত্র্যে ভাগবতে এই লণ কয়।” (মধ্যলীলা-২, ১৯ পরিচ্ছদÑ১৪৯ পয়ার)
    এই শুদ্ধ ও নির্মল ভক্তির মাধ্যমেই ভগবানকে ভালোবেসে ভজন পথে এগিয়ে যেতে হবে, নতুবা ভগবানকে লাভ করা কখনও সম্ভব নয়। ভগবানকে ভালোবাসা মানেই নিজেকে ভালোবাসা, নিজের আত্মাকে ভালোবাসা। পরমাত্মাকে ভালোবাসতে পারলে পরমাত্মার প্রতি এক আকর্ষণ জন্মে। পরমাত্মাতে যখন আকর্ষণ ও অনুরাগ জন্মায় তখন সাধকও সেই তত্ত্বে সর্বতোভাবে সমর্পিত হয়ে যান। সেই তত্ত্বে তিনি অভিন্ন হয়ে যান। তখন তাঁর আর কোনো পৃথক সত্তা থাকে না। তখন তাঁর মধ্যে ‘আমি’ বা ‘আমার’ এই বলে কোনো অহংকার বিরাজ করে না। তখন পরমাত্মা ও ভগবান এক হয়ে যান। বস্তুত এই পরমাত্মাইতো ভগবান বা পরমপুরুষ। সাধক যখন এই পরমপুরুষকে ভালোবাসতে পারেন তখন আত্মা ও পরমপুরুষ মিলে একাকার হয়ে যান। কিন্তু বিপত্তি ঘটে কখন? যখন আমরা দেহ-ইন্দ্রিয়াদি অর্থাৎÑ অনাত্মাকে আত্মা বলে মনে করি এবং সেই অনাত্মার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি তখনই আমাদের ভালোবাসা বা শুদ্ধ প্রেম অশুদ্ধ হয়ে যায়। আত্মাই ঈশ্বর আমাদের এই বোধ থাকলে সেই ভালোবাসাই শুদ্ধ প্রেম হয়। কারণ, ঈশ্বর হচ্ছেনÑ সেই আত্মাস্বরূপ। তিনিই আমাদের সকলেরই আত্মা। ঠাকুরশ্রীরামবৃষ্ণ বলেছেনÑ“হনুমান বলেছিলেন, রাম! কখনও দেখি তুমি পূর্ণ, আমি অংশ। কখনও দেখি তুমি প্রভু আমি দাস; আর রাম, তত্ত্বজ্ঞান হয়Ñ তখন দেখি তুমিই আমি, আমিই তুমি।”(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতÑ১/৩/২)
         ভক্তের মাঝে এই ভাব কখন আসে? যখন ভক্ত নিষ্ঠার মাধ্যমে সংসারের সকল কামনা-বাসনা ত্যাগ করে একমাত্র ভগবানকেই পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে অনন্য চিত্ত হয়ে তাঁর ভজনা করেন। তাই ঠাকুরশ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনÑ‘নিষ্ঠার পর ভক্তি। ভক্তি পাকলে ভাব হয়। ভাব ঘনীভূত হলে মহাভাব হয়। সর্বশেষে প্রেম। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতÑ১/৩/২
         তিনি আরও বলেছেনÑ‘প্রেম রজ্জু স্বরূপ। প্রেম হ’লে ভক্তির কাছে ঈশ্বর বাঁধা পড়েন আর পালাতে পারেন না। সামান্য জীবের ভাব পর্যন্ত হয়। ঈশ্বরকোটি না হলে মহাভাব প্রেম হয় না। চৈতন্যদেবের হয়েছিল। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতÑ১/৩/২)
         গোপীপ্রেমের কথা বলতে গিয়ে ঠাকুর বলেছেনÑ“কথক বলিলেনÑ‘যখন উদ্ধব শ্রীবৃন্দাবনে আগমন করিলেন, রাখালগণ ও ব্রজগোপীগণ তাঁহাকে দর্শন করিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া ছুটিয়া আসিলেন। সকলেই জিজ্ঞাসা করিলেন, শ্রীকৃষ্ণ কেমন আছেন। তিনি কি আমাদের ভুলে গেছেন? তিনি কি আমাদের নাম করেন? এই বলিয়া কেহ কাঁদিতে লাগিলেন, কেহ কেহ তাঁহাকে লইয়া বৃন্দাবনের নানা স্থান দেখাইতে লাগিলেন ও বলিতে লাগিলেন, ‘এই স্থানে শ্রীকৃষ্ণ গোবর্ধন ধারণ করিয়াছিলেন, এখানে ধেনুকাসুর বধ, এখানে শকটাসুর বধ করিয়াছিলেন। এই মাঠে গরু চরাইতেন, এই যমুনাপুলিনে তিনি বিহার করিতেন। এখানে রাখালদের লইয়া ক্রীড়া করিতেন, এই সকল কুঞ্জে গোপীদের সহিত আলাপ করিতেন। উদ্ধব বলিলেন,Ñ‘আপনারা কৃষ্ণের জন্য অত কাতর হইতেছেন কেন?
তিনি তো সর্বভূতে আছেন। তিনি সাাৎ ভগবান। তিনি ছাড়া কিছুই নাই।’ গোপীরা বলিলেন, ‘আমরা ওসব বুঝিতে পারি না। আমরা লেখাপড়া কিছুই জানি না। কেবল বৃন্দাবনের কৃষ্ণকে জানি  যিনি এখানে নানা ক্রীড়া করিয়া গিয়াছেন।’ উদ্ধব বলিলেন, ‘তিনি সাাৎ ভগবান, তাঁকে চিন্তা করিলে আর এ সংসারে আসিতে হয় না। জীব মুক্ত হয়ে যায়।’ গোপীরা বলিলেন, ‘আমরা মুক্তি এসব কথা বুঝি না। আমরা আমাদের প্রাণের কৃষ্ণকে দেখিতে চাই।’(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতÑ২/৫/১)                                        
         জীবের স্বভাবতই পরমাত্মার প্রতি প্রেম (রতি বা আকর্ষিত) থাকে। কিন্তু জীব যখন এই পরমাত্মার প্রতি আকর্ষিত না হয়ে প্রকৃতির প্রতি আকর্ষিত হয়ে যায় তখন সে পরমাত্মা হতে বিমুখ হয়ে যায়। যার ফলে সেÑ কামনা, বাসনা, তৃষ্ণায় ইত্যাদিতে আকর্ষিত হলে তার মধ্যে আর ভক্তি থাকে না। তাই তাকে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নানা দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। তখন তাকে এই সংসার থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনো উপায় থাকে না। এই সংসার বা ভব বন্ধন থেকে তাকে মুক্তি পেতে হলে তাকে যোগের সাধনা করতে হবে। এই সংসার বন্ধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য শ্রীভগবান গীতায় তিনটি যোগের কথা বলে গেছেন। (ক) কর্মযোগ (খ) জ্ঞানযোগ (গ) ভক্তিযোগ। গীতার এই তিনটি যোগের কথা আলোচনা করলেই দেখা যায় এই তিনটি যোগেই প্রেমের কথা রয়েছে। এই তিনটি যোগেই ঘুরে ফিরে বার বার প্রেমের কথাই বলছে। (ক) কর্মযোগে এই প্রেমকে বলা হয়Ñ কর্তব্য রতি বা কর্তব্য প্রেম। সেখানে স্বভাবজ কর্মের কথা বলা হয়েছেÑ
“স্বে স্বে কর্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ।
স্বকর্মনিরতঃ সিদ্ধিং যথা বিন্দতি তচ্ছৃণু ॥ (শ্রীগীতাÑ ১৮/৪৫)
    অর্থাৎÑনিজ নিজ কর্মে তৎপরভাবে ব্যাপৃত মানুষ সিদ্ধি লাভ করে পরমাত্মাকে লাভ করে থাকে। স্বকর্মে তৎপরভাবে ব্যাপৃত মানুষ কীভাবে সিদ্ধি লাভ করে তা আমার কাছ থেকে শোনো। কর্মযোগের এই প্রেম শেষে আত্ম রতিতে  পরিণত হয়।     
(খ) জ্ঞানযোগে এই রতি বা প্রেমকে আত্মরতি বলা হয়।  তাই জানাতে গিয়ে ভগবান শ্রীগীতায় বলেছেনÑ
“যো ’ন্তঃ সুখো ’ন্তরারামস্তথান্তর্জ্যােতিরেব যঃ।
য যোগী ব্রহ্মনির্বাণংব্রহ্মভূতো ’ধিগচ্ছতি ॥ (গীতাÑ৫/২৪)
অর্থাৎÑ যে ব্যক্তির কেবল পরমাত্মাতেই সুখ এবং কেবল পরমাত্মাতেই রত এবং যে কেবল পরমাত্মাতেই জ্ঞানযুক্ত, ব্রহ্মে নিজ স্থিতি অনুভবকারী সেই যোগী নির্বাণ ব্রহ্ম প্রাপ্ত হয়।
        যে সাধক নিজেকে অজ্ঞানের রাজ্য হতে সরায়ে এনে নিজেকে নিজ আত্মাতে স্থাপন করতে পারেন তখন তাঁর এই অবস্থা হলে সেই যোগী ব্রহ্মরূপ হয়ে জন্মমরণাতীত ব্রহ্মকেই প্রাপ্ত হয়ে থাকেন। তাইতো কবি বলে গেছেনÑ
                                             “যেথা বাহিরের আবরণ নাহি রয়,
                                              যেথা আপনার উলঙ্গ পরিচয়;
                                             আমার বলিয়া কিছু নাই একেবারে
                                             এ সত্য যেথা নাহি ঢাকে আপনারে।”
    এই শোকে কবির এই তত্ত্বটিই ব্যক্ত হয়েছে। অর্থাৎÑ সাধক পরমাত্ম তত্ত্বের সাথে অভিন্ন হয়ে এক হয়ে যান। তখন তিনি ব্রহ্মেই স্থিতি অনুভব করেন। সাধক তখন তিনি নিজেই ব্রহ্ম হয়ে ব্রহ্মতে লীন হয়ে যান।
(গ) ভক্তিযোগে এই প্রেমকেই বলা হয় ভগবৎ রতি বা ভগবৎ প্রেম। অর্থাৎÑ সাধকের এই প্রেম বা রতি ভগবানে ভক্তিরূপে হয়ে থাকে। ভক্তদের ভজনা  কোন্ ভাবে হয়ে থাকে তা জানাতে গিয়ে শ্রীভগবান  শ্রীগীতায় বলেছেনÑ
“মচ্চিত্তা মদ্গতপ্রাণা বোধয়ন্তঃ পরস্পরম্।
কথয়ন্তশ্চ মাং নিত্যং তুষ্যন্তি চ রমন্তি ॥ (শ্রীগীতাÑ১০/৯)
অর্থাৎÑ মদ্গতিচিত্ত, মদ্গতপ্রাণ ভক্তগণ নিজের মধ্যে আমার গুণ, প্রভাব আলোচনা করে এতেই সর্বদা সন্তুষ্ট থাকেন এবং আমার সঙ্গে প্রেমযুক্ত হয়ে থাকেন।

      যাঁরা ভগবানে আত্মসমর্পিত হয়ে থাকেন তাঁরা সর্বদা ভগবৎ কথাই আলোচনা করেন এবং ভগবানের নাম কীর্তনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। তাঁরা এই বিশ্বমাঝে সর্বত্রই ভগবানের মাধুরীলীলা উপভোগ করতে করতে তাঁরা এতই বিভোর হয়ে যান যে, তাঁদের রসনা তাঁরই নামের মাধ্যমে ণে ণে নব নব আনন্দের আস্বাদ লাভ করতে থাকেন।
তাই শ্রীমদ্ভাগবতেও বলা হয়েছেÑ
“বয়ং তু ন বিতৃপ্যাম উত্তমশোকবিক্রমে।
যচ্ছৃন্বতাং রসজ্ঞানাং স্বাদু স্বাদু পদে পদে ॥ (শ্রীমদ্ভাগবতেÑ১/১/১৯)
    অর্থাৎÑ পুণ্যকীর্তি ভগবানের লীলালহরী শুনতে শুনতে আমাদের কখনও তৃপ্তি হতে পারে না; কারণ, রসজ্ঞ শ্রোতার পদে পদে ভগবানের লীলার মধ্যে নব নব রসের অনুভূতি হয়। যেমনÑ পদ্ম প্রস্ফূটিত হলে সেই পদ্মে যেমন তার সৌরভ লুক্কায়িত থাকে না, নির্বাধায় চারিদিকে তা ছড়িয়ে পড়ে, যেইরূপ এই পদ্মের সেই সৌরভ জগতের সকলকে আনন্দ দান করে থাকে সেইরূপ যে সকল সাধক ভগবানে অনন্যপ্রাণ হয়ে এই সংসারের সকল স্বার্থ ত্যাগ করে ভগবানের নাম কীর্তন দ্বারা সমাজের স্তরে স্তরে পুণ্যজ্যোতি বিকীর্ণ করতে সম হন। তাতে তাঁদের দেহ ও মনের শক্তিও দিব্যভাবে রূপান্তরিত হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, এই তিন যোগের মধ্যেই প্রেমের বা ভক্তির মহিমা প্রস্ফূটিত হয়ে রয়েছে। কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, হঠযোগ ইত্যাদির মধ্যে ভগবান ভক্তিযোগকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। ভক্ত এই ভক্তিযোগের মাধ্যমেই ভগবানের সমগ্ররূপকে অতি সহজে জানতে পারেন। ভক্তিযোগীর বিশেষ মাহাত্ম্যের কথা জানাতে গিয়ে শ্রীভগবান শ্রীগীতায় বলেছেনÑ

“যোগিনামপি সর্বেষাং ম˜ ্গতেনান্তরাত্মনা।
শ্রদ্ধাবান্ ভজতে যো মাং স মে যুক্ততমো মতঃ ॥” (শ্রীগীতাÑ৬/৪৭)
অর্থাৎÑ সকল যোগীর মধ্যে যে শ্রদ্ধাবান ভক্ত আমাতে তদ্গত চিত্তে ভজনা করেন, আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।    
       এই যোগী হতে গেলে তাকে কঠোর সাধন ভজন করতে হবে। সাধন ভজনেরও বিভিন্ন ধারা রয়েছে। এই ধারাগুলোর মধ্যে কীর্তন একটি ধারা বা অঙ্গ এবং কলিযুগের জন্য এই ধারা অতি সহজ পথ। এই কীর্তনের মাধ্যমে সাধন ভজনের পথ সহজ বলে আমরা এই কীর্তনের মাধ্যমে ভগবানের স্মরণ, মনন ও কীর্তন করার চেষ্টা করি। তাতে অতি সহজে মনকে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মে নিবিষ্ট করা সম্ভব হয়। তাই ভক্তির পথ সহজ বলে কলিযুগে কীর্তন বা সংগীতের মাধ্যমে ভগবানের ভজনা করার পদ্ধতি আজ পৃথিবীর সর্বত্রই চলে এসেছে। তা সহজ ও সকলের জন্য কল্যাণপ্রদ বলে ইহার প্রভাব পৃথিবীর সর্বত্রই ল্য করা যায়।
           এই  কীর্তন বা সংগীত একটি কলা বিদ্যা। সংগীত বা কীর্তনের একটি মোহনীয় মতা রয়েছে, যা ভক্তকে ভগবানে অতি সহজভাবে নিবিষ্ট থাকতে সহায়তা করে। সংগীত বা কীর্তন হলো শব্দের অনুরণন। তাই বিশ্বকবিরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেনÑ “শব্দকে কেবলই বাড়িয়ে দিয়ে এবং চড়িয়ে দিয়ে যে জিনিসটা পাওয়া যায় সেটা হল হুঙ্কার, শব্দকে সুর দিয়ে, লয় দিয়ে সংযত সম্পূর্ণতা দান করলে যে জিনিসটা পাওয়া যায় সেইটাই হল সংগীত। ঐ হুংকারটা হল শক্তি এর পরিমাণ পাওয়া যায়, আর সংগীতটা হল অমৃত, হাতের বাইরে ওকে কোথাও মাপবার জো নেই।” এই পরম সত্যকে হৃদয়ের গভীরে উপলব্ধি করেই মনে হয় উইলিয়াম কনজার্ভ বলেছিলেনÑ “সমস্ত শিল্প কর্মের মধ্যে একমাত্র সংগীতকেই ধর্মীয় মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা যায়।”
         এই সংগীত মানব জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অতি প্রাচীনকাল হতেই মানব জীবনে সংগীতের প্রভাব ল্য করা যায়। ইহা সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা তো মানুষ, তাই সংগীত ভালোবাসি। মানুষ শুধু সংগীতকে কেনÑ পাখির কলকাকলীকেও ভালোবাসে। তাই তো পাখির মিষ্টি-মধুর ধ্বনিতে মানুষের মন উদ্বেলিত হয়। আর সংগীতের কথা তো বলাই বাহুল্য। মধুর ধ্বনি মানুষের মনের উপর এক অনিবর্চনীয় প্রভাব ফেলে থাকে তা কখনও অস্বীকার করা যায় না। তাই মহাত্মাগান্ধী বলেছিলেনÑ“সংগীত শুনিবার সঙ্গে সঙ্গে ইহা মনকে স্নিগ্ধ করে।” আর এডমণ্ড স্মিথ বলেছেনÑ “যেখানে সংগীত আছে, সেখানে বেঁচে থাকার আনন্দ আছে। যে মানুষের আত্মার সঙ্গে সংগীতের বাস সেই মানুষই ভালোবাসতে জানে।” তাহলে দেখা যাচ্ছেÑ সংগীত প্রেমের জন্ম দিয়ে থাকে।
        বৈদিক যুগেও এই সংগীত ছিল। বেদের সকল মন্ত্রগুলোকেই সংগীত বলা  হয়। আমাদের শাস্ত্রের সকল মন্ত্রগুলোই হলো সংগীত। কারণ, এইগুলো ছন্দ, লয় ও তালের সমন্বেয়েই গঠিত।
         এই সংগীতকে আমরা অনেক সময় কীর্তন বলে থাকি। কীর্তন শব্দটি এসেছেÑ কৃৎ ধাতু থেকে। যার অর্থ হলোÑ প্রশংসা। আর আমাদের শাস্ত্রকারদের মতেওÑ কীর্তন হলো, হরিকে জেনে তাঁর নাম গুণগান ও তাঁর ভজনা করার নামই হলোÑ ‘কীর্তন’। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধে কীর্তন সম্পর্কে আমরা পাইÑ ব্রজগোপীরা শ্রীকৃষ্ণের যে স্তব-গান করেছিলেন, তা-ই হলোÑ ‘কীর্তন’। সাধারণ কথায় কীর্তন হলো মৃত ব্যক্তির কীর্তি সম্পর্কে আলোচনা করা। কিন্তু এখানে ভগবানের সন্ম ুখে তাঁর স্তুতি করাকেই কীর্তন বলে। ভগবানের নাম গুণ গান করার নামই হলোÑ ‘কীর্তন’। এই কীর্তন হচ্ছে ভগবৎ ভজনার একটি অঙ্গ। ভগবৎভক্তির নয়টি অঙ্গের মধ্যে কীর্তন একটি অঙ্গ। (১) শ্রবণ (২) কীর্তন (৩) স্মরণ (৪) পাদবন্দনা (৫) অর্চনা (৬) বন্দনা (৭) দাস্য (৮) সখ্য (৯) আত্মনিবেদন। এই নববিধা ভক্তি। এই নববিধা ভক্তির মধ্য এই কীর্তন সাধন-ভজনের একটি সহজ অঙ্গ। এই সাধন-ভজনের প্রণালীর কথা জানাতে গিয়ে শ্রীভগবান শ্রীগীতায় বলছেনÑ
“সততং কীর্তয়ন্তো মাং যতন্তশ্চ দৃঢ়ব্রতাঃ।
নমস্যন্তশ্চ মাং ভক্ত্যা নিত্যযুক্তা উপাসতে ॥ (শ্রীগীতাÑ৯/১৪)
অর্থাৎÑ যে ভক্ত নিত্য আমাতে যুক্ত হয়ে যতœপূর্বক সাধন ভজন এবং ভক্তিপূর্বক কীর্তন করেন এবং আমাকে নমস্কার করেন তাঁরা আমারই উপাসনা করে থাকেন।
 এই উপাসনার কথা  জানতে গিয়ে অর্জুনের হৃদয়ে প্রশ্নের উদয় হলে  অর্জুন বললেনÑ
“স্থানে হৃষীকেশ তব প্রকীর্ত্যা জগৎ প্রহৃষ্যত্যনুরজ্যতে চ।
রাংসি ভীতানি দিশো দ্রবন্তি সর্বে নমস্যন্তি চ সিদ্ধসঙঘাঃ ॥” (শ্রী গীতাÑ১১/৩৬)

অর্থৎÑ অর্জুন বললেনÑ‘ হে হৃষিকেশ, তোমার নাম মাহাত্ম্য কীর্তন করে সমস্ত জগৎ যে হৃষ্ট হয় এবং তোমার প্রতি অনুরক্ত হয়, ইহা অতীব যুক্তিযুক্ত। রাসেরা তোমার ভয়ে পলায়ন করে এবং সিদ্ধপুরুণগণ যে তোমাকে নমস্কার করেন তা আশ্চর্য নয়।
ভক্তিভাবে ভগবানের নাম কীর্তন করলে ভগবান তাতে আনন্দ পান, এই আনন্দ পেয়ে ভগবান তখন ভক্তকে কৃপা করে থাকেন সেই কথা  জানাতে গিয়ে শ্রীভগবান বলছেনÑ   
“তেষাং সততযুক্তানাং ভজতাং প্রীতিপূর্বকম্।
দদামি বুদ্ধিযোগং তং যেন মামুপয়ান্তি তে ॥ (শ্রীগীতাÑ১০/১০)
অর্থাৎÑশ্রীভগবান অর্জুনকে বলছেন, আমাতে সতত আসক্ত হয়ে, প্রেমপূর্বক আমার ভজনাকারী ভক্তদের আমি সেই বুদ্ধিযোগ প্রদান করি, যা দ্বারা তাঁরা আমাকে প্রাপ্ত হন।
        ভগবৎ ভজনের কথা ল্য করে আমাদের শাস্ত্রকারগণও বলেছেনÑ“ভগবৎ বিষয়ে সংগীত ব্যতীত অন্য কোনো সংগীতকে কীর্তন বলা যায় না। যে সকল ভক্ত ভগবানের নাম, লীলা ও ভগবানের গুণ-গান করেন, তা-ই হলোÑ ‘কীর্তন’। অর্থাৎÑ সুর, লয় ও তাল দিয়ে ভগবানের নাম-গুণগান করাই হলোÑ ‘কীর্তন’। আর এই কীর্তন যখন বহুলোক একত্রিত হয়ে উচ্চ স্বরে করে থাকেন, তখন তাকে বলা হয় সংকীর্তন। বৈষ্ণবগণের মতেÑ কলিযুগে শ্রেষ্ঠ ধর্মই হচ্ছেÑ এই  ‘নাম সংকীর্তন’।
        আজকাল বহুস্থানেই নাম সংকীর্তন হচ্ছে এবং হতে দেখা যায়। কোথাও কোথাও অষ্টপ্রহর, ষোলপ্রহর, চব্বিশপ্রহর, চৌষষ্ঠটি প্রহর প্রভৃতি সময় ধরে নাম সংকীর্তন করা হয়ে থাকে। আজকাল আমরা এই সমস্ত নামসংকীর্তন দেখি বিভিন্ন রাগ-রাগিনী, বিভিন্ন তাল ও ছন্দে করা হয়ে থাকে। ইহার মূল উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন সুরের ব্যঞ্জনায় মনকে ভগবানের পাদপদ্মে নিবিষ্ট করা। শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দ প্রভু এই নাম  সংকীর্তনের মাধ্যমে ভজনার পথ সুগম করেছিলেন। তাঁরাই এই নামের মাধ্যমে ভক্তি জগতে এক নব ভাবগঙ্গা এনেছিলেন। কলিকালে নাম সংকীর্তনের জনক এই দুইজনকেই বলা হয়।
       কলিকালে এই হরিনাম সংকীর্তন করলে যাগ, যজ্ঞ ইত্যাদির ফল লাভ করা যায়।   নাম সংকীর্তনের মাধ্যমেই ভক্তের হৃদয়ে প্রেমের ভাব উদয় হয়। ভগবানের প্রতি মনের আকুলতার উদয় হলে আপন হৃদয়ে যে স্বার্থশূন্য বিমল ভাবের উদয় হয় তা-ই হলো ‘রতি’ বা ‘ভক্তি’। আর ভগবানে এই রতি গাঢ় হলেই তাকে বলা হয় ‘প্রেম’। যাঁরা প্রকৃত ভক্ত

    তাঁরা মো কামনা করেন না। কারণ, মো কামনাও এক প্রকারের স্বার্থপরতা। তাঁদের মতেÑ ভগবানই একমাত্র কাম্য বস্তু। তাঁরা ভগবান ব্যতীত আর কিছুই চান না।
এই ভগবানকে লাভ করতে হলে চাই আপন চিত্ত শুদ্ধি। ভগবান ভজনেই চিত্তশুদ্ধি হয়ে থাকে। চিত্তশুদ্ধি ব্যতীত কখনও ভগবৎ দর্শন হয় না। নাম সংকীর্তনের উদ্দেশ্যই হচ্ছেÑ আপন চিত্তশুদ্ধি। ভগবানের নাম চিন্তা করা, তাঁর নাম গুণগান করা, ইহাই নাম সংকীর্তনের মূল উদ্দেশ্য ও ল্য। এক কথায় ভগবৎ সেবাই হলো নাম সংকীর্তনের চরম ও পরম  ল্য।
         আজ আমাদের সমাজের সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে এই নাম সংকীর্তনের প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে।  এই কীর্তনে জাতি, বর্ণ, শ্রেণী নির্বিশেষে সমাজের সর্বস্তরের মানুষই এই কীর্তনে অংশ গ্রহণ করে থাকেন।  এই নাম সংকীর্তনের মধ্যে সাম্যতার একটি অপূর্ব রূপ ও ভাব পরিলতি হয়।
    সমাজের সকল শ্রেণীর লোকসহ একত্রে অংশ গ্রহণ করে আনন্দ লাভ করে শ্রীভগবানকে ভজনা করে থাকেন।  এই সাম্যতার ভাব সকলকেই বড় আনন্দ দান করে এবং এই নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে সাধন-ভজন করে কলির জীব অতি সহজে মুক্তি পেতে পারে। তাই শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছেÑ 
                                             “হর্ষে প্রভু কহেÑশুন রামরায়।                         
                                              নাম স্কংীর্ত্তন কেলৌ পরম উপায় ॥
                                              সঙ্কীর্ত্তন-যজ্ঞে করে কৃষ্ণ-আরাধন।
                                              সেই ত সুমেধা পায় কৃষ্ণের চরণ ॥
                                              নামসঙ্কীর্ত্তন হৈতে সবর্ব্বানর্থনাশ।
সর্ব্বশুভোদয় কৃষ্ণপ্রেমর উলাস ॥”
(শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতÑ অন্তলীলা, ২০পরিচ্ছেদÑ৭,৮,৯)
অতি আনন্দিত হয়ে মহাপ্রভু রায় রামানন্দ ও স্বরূপ দামোদরকে বললেনÑ“কলিযুগে শ্রীশ্রী নামসংকীর্তনই হলো সর্বশ্রেষ্ঠ সাধন। কলিতে এই নাম সংকীর্তনের মতো এত সহজ পথ আর নেই।  ভক্তের মধ্যে ভক্তির ভাব উদয় হলেই ভক্তের মধ্যে যথারীতি  এক উন্মাদনার ভাব উদয় হয়। তখন স্থান, কাল আর পাত্রের কোনো ভেদাভেদ থাকে না। যেখানে সেখানেই হরির নাম নেওয়া যায়। তাই (শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে বলা হয়েছেÑ
                               “খাইতে শুইতে যথা-তথা নাম লয়।
                         দেশ-কাল-নিয়ম নাহি, সর্ব্বসিদ্ধি হয় ॥”
(শ্রীশ্রী চৈতন্যচরিতামৃতÑ অন্তলীলা, ২০পরিচ্ছেদÑ১৪)              
এইভাবে যথা-তথা, যখন-তখন নাম কীর্তন করতে করতে ভক্তের মধ্যে ভগবানের জন্য দিব্যভাবের উদয় হয়ে যায়। তখন ভক্ত দিব্যোন্মাদ হয়ে যান। হৃদয়ে নামের উন্মাদনা ভাব তাঁর মধ্যে উদয় হলে তিনি নামের প্রেমে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেন। ইহা নাম সংকীর্তনের প্রভাবেই  ভক্তের হৃদয় এইভাবে উদ্বেলিত হয়। তাই এই নাম সংকীর্তন আনন্দের এক অপূর্ব অভিব্যক্তি। যার ফলে এই কীর্তন সাধককে ভক্তি বা প্রেমের রাজ্যে লয়ে গিয়ে তাঁকে ভগবানের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক অভিনব উপায়, যে উপায় যুগ যুগ ধরে আমাদের ভজনার পথকে চিরসুগম করে আসছে। এই নাম সংকীর্তনের কথা বলতে গিয়ে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণও বলেছেনÑ
শ্রীরামকৃষ্ণ। “হ্যাঁ, ওরা বেদান্তবাদী, কিন্তু ভক্তিমার্গও মানে। কি জান, এখন কলিতে তন্ত্র মত। তন্ত্রমতে কি পুরশ্চণ হয় না?”(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতÑ২/৯/১)   
         সর্বশেষে তিনি বলেছেনÑ“কলিতে নারদীয়া ভক্তিÑ সর্বদা তাঁর নাম-গুণ-কীর্তন করা। যাদের সময় নাই, তারা যেন সন্ধ্যা-সকালে হাততালি দিয়ে এক মনে হরিবোল, হরিবোল বলে, তাঁর ভজনা করে।”(শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃতÑ৩/১১/৩)
        তাই আসুন, ভক্তির সহজ পথ এই নাম সংকীর্তন করে ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম লাভ করার জন্য আমরা সকলেই সচেষ্ট হই। ইহাই হোক আমাদের সকলের একান্ত প্রত্যাশা।  পরমপুরুষ ভগবান আমাদের সকলের মঙ্গল করুন।
ওঁ শান্তি          ওঁ শান্তি        ওঁ শান্তি     ॥ the end

0 comments:

Post a Comment